বক্তাবলীর ২২ টি গ্রামই জ্বালিয়ে দিয়েছিলো হানাদাররা। নির্বিচারে হত্যা করেছিলো বক্তাবলীর সাহসী বীরদের। তারপর পেরিয়ে গেছে ৪৮ বছর। তবে কেন এখনো জ্বলছে বক্তাবলী? শহীদ পরিবারগুলোর হৃদয়ের পোড়াক্ষত আর রক্তঅশ্রু এখনো কেন মুছে দিতে পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশ? শহীদদের আত্মত্যাগকে পদদলিত করে ইতিহাস মুছে দেয়াই কী তবে স্বাধীনতা? তারা বুক চিতিয়ে প্রাণ দিয়ে গেলো আমাদের । আর আমরা....? সামান্য ‘শহীদ’ স্বীকৃতিটুকু দিতে পারলাম না! বাংলাদেশ রাষ্ট্র কী এতোটাই দরিদ্র! এতোটাই অকৃতজ্ঞ! জাতি হিসেবে কি আমরা এতোটাই অক্ষম?
বক্তাবলীকে জানুন:
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা জুড়েই শত্রুমুক্ত ছিলো বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী ঘেরা দূর্গম বক্তাবলী পরগনা। যুদ্ধের শুরু থেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বক্তাবলীতে ভীর করে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ। বর্ষার শেষের দিকে মুক্তারকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কানাইনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ঘাটি গড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। বক্তাবলী থেকেই নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার অপারেশন সংগঠিত হতো জানিয়ে যুদ্ধকালীন কমান্ডার আমিনুর রহমান বলেন, ‘ মুক্তিযোদ্ধের পুরোটাজুড়েই বক্তাবলীতে আশ্রয় নেয়া লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের আগলে রেখেছিলো বক্তাবলীর কৃষক পরিবারগুলো। তাদের আন্তরিকতার কারনে ছোটবড় প্রায় ১২ টি মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠে বক্তাবলীতে। তাদের আশ্রয় ও খাবারের সংস্থান করেছে বক্তাবলী পরগণার ২২ টি গ্রামের মানুষ। এখানেই স্থানীয়দের কেউ কেউ প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।’
২৯ নভেম্বর ১৯৭১:
কুয়াশাচ্ছন্ন ছিলো ২৯ নভেম্বরের ভোর। নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় ২৮ নভেম্বর মধ্য রাতেই গানবোটসহ ধলেশ্বরীতে অবস্থান নেয় হানাদার বাহিনী। বক্তাবলীকে তিন থেকে থেকে ঘিরে ফেলে। ভোঁর হতেই বক্তাবলী চরে নামতে থাকে পাকিস্তানী সেনারা। হানাদারদের উপস্থিতি টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে প্রায় ২ ঘন্টা প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। এই সময়ের মধ্যেই বক্তাবলীর ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ পাশের মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হয়। প্রতিরোধের মুখে প্রথম দফায় পিছু হটলেও ভারি অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ফের বক্তাবলীর গ্রামগুলোতে হামলা চালায় হানাদাররা। বিকেল পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ফিরে যায় তারা।
সেদিনের ঘটনা স্মরন করতে পারেন মুক্তিযোদ্ধা তমিজউদ্দিন রিজভী। বলেন, ‘মাহফুজুর রহমানদের প্রতিরোধের সময়ই আমরা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিই। ওদের আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রের মুখে আমাদের লড়াই করা সম্ভব ছিলো না। সারাদিনই ওরা গ্রামগুলোতে তা-ব চালিয়েছে।’ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বৃদ্ধ সেকান্দার আলী জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে গান পাউডার দিয়ে বক্তাবলীর ২২ টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা। গ্রামের যুবকদের ধরে হত্যা করে। ডিক্রিচর ঘাটে একসঙ্গে হত্যা করা হয় ৪০ জনকে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা হিসেব করে দেখেন, ২৯ নভেম্বরের বক্তাবলী গণহত্যায় ১৩৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হয়েছে।
হারিয়ে যাচ্ছে বক্তাবলীর ইতিহাস:
১৯৭১ সালের ছাই হয়ে যাওয়া ভিটাগুলোতে নতুন বসতি গড়েছেন শহীদ পরিবারের সন্তানরা। ছাই হয়ে যাওয়া পিতৃভুমি আবারো সাজিয়েছেন নতুন করে। তবে গত ৪৮ বছরেও ২৯ নভেম্বরের শহীদ ১৩৯ জনকে সরকারি স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। লিখা হয়নি গণহত্যার ইতিহাস। সম্প্রতি বক্তাবলী গণহত্যা নিয়ে কথা হয়েছে মুক্তারকান্দি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মুক্তারকান্দি প্রাথমকি বিদ্যালয় ও কানাইনগর ছোবহানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্তত ২১ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ‘মুক্তিযোদ্ধের সময় বক্তাবলীতে কী হয়েছিলো?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলেছেন ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো। কেউ বলেছেন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা মারা গিয়েছিলো। তাদের কেউই মুক্তিযুদ্ধে বক্তাবলীর অবদান কিংবা ২৯ নভেম্বরের গণহত্যার ইতিহাস বলতে পারেনি।
কানাইনগরের মুক্তিযোদ্ধা গিয়াসউদ্দিন বলেন, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তাবলী গণহত্যায় শহীদ পরিবারদের প্রতি চিঠি লিখে সমবেদনা জানিয়েছিলেন। শহীদ পরিবার প্রতি ২ হাজার ও আহতদের ৫শ করে আর্থিক সহযোগিতাও করেছিলেন। তারপরের ৪৭ বছরে কোন সরকারই শহীদ পরিবারগুলোর কথা মনে রাখেনি।’ বক্তাবলী গণহত্যার ইতিহাস রক্ষায় ১৩৯ শহীদ ও লক্ষ্মীনগর বধ্যভূমিকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি প্রদান ও সরকারিভাবে বক্তাবলী দিবস উদযাপনের দাবি জানান ‘বক্তাবলী পরগনা মুক্তিযোদ্ধে শহীদ পরিবার সংঘ’র সভাপতি হারুন অর-রশীদ।
একটি মুক্তিযুদ্ধ। একটি পরগনা। ২২ টি গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ই মুক্তাঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধাদের ১২ টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ঘাটি। পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি পালিয়ে আসা আশ্রিত লোক। ২৯ নভেম্বর ১৯৭১! বক্তাবলী জ্বলছে। গণহত্যা। ১৩৯ এর চেয়েও বেশি শহীদ! স্বাধীনতার ৪৮ বছর। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র! আত্মদানের স্বীকৃতি চেয়ে শহীদ পরিবারগুলোর হাহাকার। হাজারো প্রতিশ্রুতি! হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস! রাষ্ট্রের নির্লজ্জতা! নারায়ণগঞ্জবাসীর নির্লজ্জতা! আমাদের দারিদ্রতা। আমাদের অক্ষমতা। ৪৮ বছর পরের বক্তাবলী।
গোলাম রাব্বানী শিমুল
জেলা প্রতিনিধি - নারায়ণগঞ্জ ।