একসময় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় জনপ্রিয় হস্তশিল্প হিসেবে পরিচিত মাদুলি বা তাবিজ তৈরির শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো এই ঐতিহ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এবং ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে তার কদর হারাচ্ছে।
আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকে মাদুলির ব্যাপক চাহিদা ছিল। সে সময় হাটবাজারের প্রতিটি কোণায় মাদুলি প্রস্তুতকারকদের দেখা যেত। কোরআনের আয়াত, আরবি দোয়া বা বিশেষ চিহ্নের মাধ্যমে তৈরি এই মাদুলি রোগ-শোক থেকে মুক্তি, সাংসারিক কল্যাণ ও আত্মরক্ষার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
হ্রাস পাচ্ছে কারিগর ও চাহিদা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় রূপগঞ্জে পাঁচ শতাধিক মাদুলি তৈরির কারিগর থাকলেও এখন সেই সংখ্যা দুই শতাধিক পরিবারে নেমে এসেছে। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, পুঁজি সংকট এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কারণে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে মাদুলিকে ‘শিরক’ (আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থাপন) হিসেবে গণ্য করার ফলে এর ব্যবহার কমেছে।
সংকটে মাদুলি শিল্পীরা
মাদুলি তৈরির কাজ অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য। তামা, ব্রোঞ্জ, দস্তা, লোহা, পিতলের মতো কাঁচামাল সংগ্রহ করে তা ঢালাই, ঝালাই ও রঙিন করা হয়। প্রতি কেজি কাঁচামাল ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় কিনতে হয়। রামপ্রসাদ অধিকারী নামে এক কারিগর জানান, প্রতিটি মাদুলি তৈরি করতে খরচ হয় ৮০ পয়সা থেকে ১ টাকা, কিন্তু পুঁজির অভাবে পাইকারদের কাছে তা মাত্র ১ টাকা ২০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রি করতে হয়। নিজস্ব পুঁজি থাকলে দেড় থেকে দুই টাকায় বিক্রি করা যেত।
সরকারী সহায়তার আবেদন
এ শিল্পের প্রবীণ ও নবীন কারিগরদের কণ্ঠে হতাশার সুর থাকলেও তারা পৈতৃক পেশাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তাদের মতে, সহজ শর্তে ঋণসহ কিছু সরকারি সহায়তা পেলে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। মাদুলি কারিগর দিলীপ মণ্ডল বলেন, ‘আয় কম, খরচ বেশি। সরকারি সহায়তা পেলে হয়তো এ পেশা ধরে রাখা সম্ভব হতো।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি এ শিল্পের বিষয়ে অবগত। তিনি দ্রুত কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে সরকারি সহায়তা দেওয়া যায়, তা নিয়ে চেষ্টা করবেন।
একসময় রূপগঞ্জের মাদুলি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যেও রপ্তানি হতো, কিন্তু এখন তা প্রায় বন্ধ। আধুনিক চিকিৎসা ও শিক্ষার প্রসার এবং ধর্মীয় সচেতনতা এই শিল্পের পতনের মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।